বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্য পূরণে বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য দরকার মানসম্মত শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া এসডিজি লক্ষ্য পুরণ করা সম্ভব নয়। এজন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দরকার।
শিক্ষা ক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতিই পারে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রধান হাতিয়ার হলো কম্পিউটার। প্রাইমারী স্কুল থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় কম্পিউটার ও আইসিটি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হলেও কম্পিউটার শিক্ষকের অভাবে এসব ল্যাব অচল হয়ে পড়ে আছে। সরকারী স্কুল ও কলেজে এখনো কোনো আইসিটি শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার।
অন্য বিষয়ের শিক্ষক বা পারটাইম শিক্ষক দিয়ে ক্লাস/ল্যাব পরিচালনা করে আসছে। আর বেসরকারী (স্কুল,কলেজ,মাদ্রাসা ও এমপিও,ননএমপিও)শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা আরও নাজেহাল।
ফলে শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক না থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনটিআরসিএ ও মাউশির সমন্বয় হীনতা। কোনো সমন্বয় না করেই একেক সময় একেক ধরনের পরিপত্র জারী করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় হঠাৎ ১৪ জুন ২০১৫ সালে এক পরিপত্রজারি করে এতে বলা হয়, জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১০ ( সংশোধিত ২০১৩) এর পরিশিষ্ঠ-ঘ, সহকারী শিক্ষক কম্পিউটার শিক্ষাগত যোগ্যতা পরিবর্তন করা হল।
সহকারী শিক্ষক কম্পিউটার শিক্ষাগত যোগ্যতা, কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক অথবা তিন বছর মেয়াদী কম্পিউটার ডিপ্লোমা। যা নীতিমালা-২০১০ এ যেকোনো বিষয়ে ২য় শ্রেণীর স্নাতক ডিগ্রীসহ সরকার অনুমোদিত যে কোনো প্রতিষ্ঠান হতে ন্যূনতম ৬(ছয়) মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের আবেদনের সুযোগ ছিল।
এ নিয়ম কার্যকর হওয়ার কথা পরবর্তী অর্থাৎ ১৩ তম নিবন্ধন পরীক্ষা থেকে। আর ১ম -১২ তমরা যেহেতু আগের নীতিমালা ও বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সনদ অর্জন করেছে এবং সনদের মেয়াদ আজীবন। কিন্তু এনটিআরসিএ ১ম-১২ তমের উপর এই শর্ত আরোপ করে। আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১১ নভেম্বর ২০১৫ সালে আর একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা এনটিআরসিএকে দেয়। যা আগে সনদ প্রদানের ক্ষমতা ছিল এনটিআরসিএর হাতে আর নিয়োগ দানের ক্ষমতা ছিল প্রতিষ্ঠানের কমিটির হাতে।
এ পরিপত্রে বলা হল-এনটিআরসিএ প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শুন্যপদের তথ্য সংগ্রহ করে, পিএসসির আদলে (প্রীলিমিনারী, লেখিত, ভাইভা) একটি নিবন্ধন পরিক্ষার গ্রহনের মাধ্যমে উপজেলা, জেলা ভিত্তিক শুন্যপদে মেধার ভিত্তিতে ১জন প্রার্থীকে সুপারিশ করবে। সনদের মেয়াদ হবে ৩ বছর। কিন্তু ১-১২ তমের সার্টিফিকের মেয়াদ ছিল আজীবন। এনটিআরসিএ ২০১৬সালে প্রথম গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে করে ১ম -১২ তম নিবন্ধন সনদ অর্জনকারীর অনেকেই সনদের বৈধতা হারায়। ছয়মাস মেয়াদী সনদধারী সহকারী শিক্ষক, কম্পিউটার আবেদন করতে না পেরে, তারা আদালতের দ্বারস্থ হলে আবেদনের সুযোগ পায় এবং মহামান্য হাইকোর্ট ছয়মাস মেয়াদী ডিপ্লোমাধারীদের পক্ষে রায় দেয়। ১০৯৫ টি শুন্যপদের মধ্যে মাত্র ৩৪৪ জন নিয়োগ পেয়েছে এবং অবশিষ্ট ৭৫১টি পদে অন্যকোনো প্রার্থী সুপারিশ করেনি এনটিআরসিএ।
এদিকে অন্যান্য পদের নিবন্ধিত পার্থীরা তাদের সনদের বৈধতা ফিরে পেতে মহামান্য হাইকোটে ১৬৬টি মামলা দাখিল করে এনটিআরসিএ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে এনটিআরসিএ ২০১৫ সালের নতুন পরিপত্র অনুযায়ী ১৩ তম ও ১৪ তম নিবন্ধন পরীক্ষা সম্পন্ন করে। কিন্তু এনটিআরসিএ পরিপত্র অনুযায়ী ১৩ তমের নিয়োগ দিতে তালবাহানা শুরু করলে ১৩তমরা আদালতের আশ্রয় নেয় এবং দাবি অনুযায়ী তারা রায় পায়। কিন্তু এনটিআরসিএ আবার আপিল করে যা বর্তমান চলমান। ১৪ই ডিসেম্বর,২০১৭ সালে মহামান্য হাইকোট ৭ টি নির্দেশনা দিয়ে ১৬৬ মামলার মিমাংশিত রায় প্রদান করে। তার ১ নং নির্দেশনা ছিল-নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সনদের মেয়াদ বহাল থাকবে এবং ২নং-রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৯০দিনের মধ্যে উত্তীর্ণদের নিয়ে জাতীয় মেধা তালিকা করতে হবে।
এনটিআরসিএ রায় অনুযায়ী জাতীয় মেধা তালিকা তৈরি করে এবং ছয় মাস মেয়াদী কম্পিউটার ডিপ্লোমা সহ সকল নিবন্ধনধারী স্থান পায়। আবার ১২ই জুন,২০১৮ সালে জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ জারি করে।
এনটিআরসিএ গত ২৪ই জানুয়ারী, ২০১৯ ইং তারিখে ২য় চক্রে ৩৯৩১৭ জন প্রার্থী সুপারিশ করে। কিন্তু এ নিয়োগে জাতীয় মেধা থেকে সুপারিশ পেয়েও যোগদান করতে পারেনি প্রভাষক “তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি” ও কম্পিউটার অপারেশন এবং সহকারি শিক্ষক “ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির” সুপারিশকৃত প্রার্থীরা। কেননা ২৯ জানুয়ারী,২০১৯ সালে এনটিআরসিএ একটি নোটিসে জানায় ‘জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমানা-২০১৮” অনুযায়ী যোগ্যতা না থাকায় ৬ (ছয়) মাস মেয়াদী কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নিবন্ধনধারীরা যোগদান করতে পারবে না। যদিও জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালার-২০১৮ জারির আগে পাশকৃতদের বাদ দেওয়ার কথা নয়। কারণ বিভিন্ন নিবন্ধন পরীক্ষার সার্কুলার ও মহামান্য হাইকোটের রায় অনুযায়ী তাদের যোগ্যতা সঠিক ছিল। উল্লেখ্য ১ম হতে ১৪তম নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রভাষক আইসিটি ও কম্পিউটার অপারেশন পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল কম্পিউটার/আইসিটিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর অথবা বিজ্ঞান বিভাগে(পদার্থ, রসায়ন, গণিত, পরিসংখ্যান, প্রানীবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান) ২য় শ্রেণীর স্নাতকোত্তর ডিগ্রীসহ সরকার অনুমোদিত যে কোনো প্রতিষ্ঠান হতে ন্যূনতম ৬(ছয়) মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত।
কিন্তু ‘জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমানা-২০১৮” তে শুধু কম্পিউটার বিজ্ঞান/আইসিটিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কথা বলা হয়েছে। যেহেতু ২০১৫ সালের পরিপত্র অনুযায়ী পিএসসির আদলে প্রীলি, লেখিত, ভাইভা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে সেহেতু একটি নিবন্ধন পরীক্ষা শেষ করতে এক বছরের অধিক সময় লেগে গেছে। তাই ১৩ ও ১৪ তমদের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের নীতিমালা প্রযোজ্য হওয়ার কথা নয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ১৩তম ও ১৪তম নিবন্ধন পাশ করলেও জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালার- ২০১৮ কারনে কোনো নিয়োগের আগেই অযোগ্য ঘোষিত হয়েছে ছয়মাস মেয়াদী আইসিটি প্রভাষকরা। যদি নিয়োগের আগেই অযোগ্য যোষিত হয় তাহলে ১৩ ও ১৪ তম প্রভাষক, আইসিটি পদে পাস করানো হলো কেন, বিষয়টি বোধগম্য নয়।
এ পর্যন্ত এনটিআরসিএ সহকারী শিক্ষক, কম্পিউটার পদে ১৯০৯০টি ও প্রভাষক, আইসিটি পদে ৩৫৫৬টি এবং কম্পিউটার অপারেশন পদে ৯১৬ টিসহ মোট ২৩৫৬২টি সনদ প্রদান করে। কিন্তু এমপিও ও নন এমপিও ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩০ (ত্রিশ) হাজারের উপরে এবং নীতিমালা অনুসারে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে একজন আইসিটি শিক্ষক বাধ্যতামুলক করা হয়েছে।
প্রতি ক্লাসে ৫০ জনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী থাকলে আরও শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া বিধান রয়েছে। এ হিসাবে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা) ৪০ (চল্লিশ) হাজারের উপরে আইসিটি শিক্ষক প্রয়োজন। কিন্তু এনটিআরসিএ আইসিটি পদে সর্বমোট সনদ দিয়েছে ২৩৫৬২টি। যেখানে ছয় মাস মেয়াদী ডিপ্লোমাসহ নিবন্ধনধারী ২৩৫৬২জন। সেখানে কিভাবে এনটিআরসিএ ছয়মাস মেয়াদীদের বাদ দিয়ে শুধু কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রীধারীদের দিয়ে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাহিদা পুরণ করবে? বলা বাহুল্য কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে চাকুরি করে, আর বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেতন ভাতা খুবই সামান্য। ছয়মাস মেয়াদীরা পিএসসি আদলে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে। জাতীয় মেধা তালিকায় স্থান পেয়েও কেনো নিয়োগ বঞ্চিত হবে। মন্ত্রণালয় ও এনটিআরসিএতে যোগাযোগ করা হলে এক পক্ষ আর এক পক্ষের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনটিআরসিএর সমন্বয়হীনতা এবং বার বার নীতিমালা পরিবর্তনের কারণে শিক্ষক সংকটের শুরু হয়েছে। ছয়মাস মেয়াদী ডিপ্লোমা ধারীরা আদালতের রায় থাকা শর্তেও নিয়োগ বঞ্চিত হচ্ছে। তাই আজ বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার পদ শুন্য থাকা শর্তেও শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ছাত্রছাত্রীরা তাদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসসহ সব ধরনের আইসিটি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব কারণে সরকারের যে স্বপ্ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, তা ব্যহত হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সরবরাহকৃত, কম্পিউটার ও কম্পিউটার ল্যাব পরিচালনার অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এসব কারণে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালার-২০১৮ এর কারণে হাজার হাজার নিবন্ধিত প্রার্থী তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাই নীতিমালা সংশোধন করে, বিষয়টি সমাধানের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং নিবন্ধিত সকল শিক্ষকে নিয়োগ দিয়ে,আইসিটি শিক্ষার মান উন্নত করে, এসডিজি লক্ষ্য পূরণে এক ধাপ এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়]
লেখক: মো. সাইফুর রহমান, সহকারী শিক্ষক (গণিত), বাহুবল, হবিগঞ্জ।