এই শীতের ভ্রমণের জন্য আদর্শ জায়গা হতে পারে ভারতের সিকিম। এটি দেশটির একটি অন্যতম ক্ষুদ্রতম রাজ্য এবং পর্যটন শহর।ভারতের উত্তর পূর্বে অবস্থিত সিকিমকে ঘিরে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ভুটান, নেপাল এবং তিব্বত।
৭০০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সিকিমের মোট জনসংখ্যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৬ লাখ। সিকিমের বৃহত্তম শহর এবং রাজধানীর নাম গ্যাংটক।
বাংলাদেশ থেকে সহজে ও কম খরচে ভ্রমণ করা যায় সিকিমে।
সিকিম চমৎকার পাহাড়ি ঝর্ণা, গভীর উপত্যকা, ঔষধি গাছের বন এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য পরিপূর্ণ। সিকিম উত্তর সিকিম, পূর্ব সিকিম, দক্ষিণ সিকিম এবং পশ্চিম সিকিম এই চার জেলার সমন্বয়ে গঠিত।
আলপাইন চারণভূমি, পাহাড়, হিমবাহ ও হাজারো বুনো ফুলে ভরা সিকিমের গ্যাংটক ও লাচুংয়ের মতো উপশহরের প্রতিটা জায়গা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। আর পূর্ব সিকিমের অপার সৌন্দর্যের ধারক সাঙ্গু লেক এই শহরের আরেক বিশেষ আকর্ষণ। গ্যাংটক হলো সিকিমের সকল শহরে যাতায়াতের মূল কেন্দ্রস্থল।
সিকিমে রয়েছে সুন্দর এবং বিচির সব উদ্ভিদ এবং প্রাণী। রডোডেন্ড্রন, অর্কিড ফুল, সাথে লাল পান্ডা, লাল রঙ্গিন পাখি গ্যাংটকের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। গ্যাংটকে পর্যটকদের মন মাতানোর জন্য অনেক হ্রদ, ঝর্ণা ও পাহাড় রয়েছে। তবে এদের মধ্যে সোমগো ও মেনমেকো হ্রদই বেশি পরিচিত।
বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন পাওয়া যাবে গ্যাংটক থেকে। হট স্প্রিংগুলো সালফারের উচ্চ ঘনত্বের কারণে ভেষজ গুণের জন্য সুপরিচিত।
সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে রয়েছে সবচেয়ে বড় শপিং কমপ্লেক্স এম জি মার্গ বা মহাত্মা গান্ধী মার্গ। মাঝে বসার জায়গা, দুই পাশে সুসজ্জিত দোকানপাট, পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট- সবমিলিয়ে একটা অন্যরকম স্বর্গীয় পরিবেশ। এম.জি.মার্গে মহাত্মা গান্ধীর খুব সুন্দর একটি মূর্তি স্থাপিত আছে।
ছাঙ্গু লেকের স্থানীয় নাম সোমগো। গ্যাংটক থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে ১২ হাজার ৪০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই লেক। শীতকালে ছাঙ্গুলেকের জল জমে বরফ হয়ে যায়। লেকের চারিদিকে বরফে ঢাকা পাহাড়ের সৌন্দর্যই অন্যরকম। এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকেরা একবার হলেও ইয়াকের পিঠে চড়েন। তবে এই রাস্তায় আসতে হলে আগে থেকেই অনুমতি নিয়ে আসতে হয়। ছাঙ্গুলেক যাওয়ার পথেই পড়বে বাবা মন্দির। একই রাস্তায় তিনটি ঘোরার জায়গা ছাঙ্গু হ্রদ, নতুন বাবা মন্দির আর পুরানো বাবামন্দির বা বাবার বাঙ্কার।
সিকিমের বিখ্যাত খাবার হচ্ছে মোমো। রাস্তার পাশে সারাক্ষণই মোমো বিক্রি হতে থাকে, এছাড়া রয়েছে ইয়াকের পনির এবং পানিপুরির আয়োজন।
ভ্রমণের সময়
সিকিমের তাপমাত্রা বেশির ভাগ সময়ই খুব কম থাকে। বলা হয়ে থাকে সিকিমের বৃষ্টিপাতের ও কোনো ঠিক নেই। সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি সিকিম ভ্রমণের জন্য আদর্শ সময়।
যেভাবে যাবেন
সিকিম যাওয়ার জন্য প্রথমে বাসে করে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা যেতে হবে। ঢাকা থেকে হানিফের বাস সরাসরি বাংলাবান্ধা যায়। বাংলাবান্ধায় বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন শেষ হলে ইন্ডিয়ান বর্ডারের ইমিগ্রেশন শেষ করে অটোতে ফুলবাড়ি বাসস্ট্যান্ড যেতে হবে। ফুলবাড়ি থেকে বাসে ১০ রুপি খরচ করে শিলিগুড়ি পৌছাতে হবে।
শিলিগুড়িতে পৌঁছেই ম্যাপ দেখে SNT (Sikkim Nationalized Tranport) অফিস গিয়ে সিকিম ভ্রমণের অনুমতি নিতে হবে। পারমিশনের ক্ষেত্রে অন্তত ১০ দিনের পারমিশন নেয়া ভালো। শিলিগুড়ি থেকে সিকিমের রাজধানী শহর গ্যাংটকের দূরত্ব ১১৪ কিলোমিটার। সড়ক পথে শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক যেতে প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। শিলিগুড়ির সিকিম ন্যাশনালাইজড ট্রান্সপোর্ট (SNT) বাস টার্মিনাল কিংবা NJP স্টেশন থেকে শেয়ার গাড়ি ভাড়া নিলে জনপ্রতি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ হবে। বাস ভাড়া লাগবে জনপ্রতি ১২০ টাকা।
সিকিম যাওয়ার গাড়ি ভাড়া করার ক্ষেত্রে সিকিমের রেজিস্ট্রিত গাড়ি ভাড়া করার চেষ্টা করতে হবে। ওয়েস্ট বেঙ্গল কিংবা অন্য রাজ্যের রেজিস্ট্রেশনের গাড়ি গ্যাংটক সিটি সেন্টারের ২ কিলোমিটার নীচে দেওরালিতে নামিয়ে দেবে। তখন আবার অন্য গাড়ি ভাড়া করে আসতে হবে।
ট্যুর প্ল্যান
১ম দিন: রাতের বাসে ঢাকা থেকে বাংলাবান্ধা। ইমিগ্রেশন শেষ করে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা। শুলিগুড়ি থেকে সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক। হোটেল বুকিং দিয়ে পরদিন সাইট সিয়িংয়ের জন্য গাড়ি ঠিক করা। গ্যাংটক সাইট সিয়িংয়ের জন্য পুরো গাড়ি রিজার্ভ নিতে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা লাগে। সিজন ভেদে ভাড়ার পরিমাণ কম বেশি হয়ে থাকে।
২য় দিন: সকাল ৮টায় গ্যাংটক সাইট সিয়িংয়ের জন্য রওনা দিয়ে দিন। হনুমান টক, কয়েকটা মনেষ্ট্রী, রোপওয়ে, মিউজিয়াম, টাসি ভিউ পয়েন্ট, বানঝাকরি ওয়াটারফল ইত্যাদি সহ ৭ থেকে ১১ টি স্থান ঘুরে দেখতে পারবেন। ফিরে এসে নর্থ সিকিম ঘোরার জন্য প্যাকেজ নিয়ে নিন। নর্থ সিকিমে ২ দিন ১ রাত ঘুরার রুট হবে গ্যাংটক-লাচুং-ইয়ুমথাং ভ্যালী-গ্যাংটক।
৩য় দিন: সকাল ৭টার মধ্যে গ্যাংটক থেকে ১২২ কিলোমিটার দূরে লাচুংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা। ৪র্থ দিন: সকালে লাচুং থেকে ইয়ানথাম ভ্যালি হয়ে গ্যাংটক ফিরে আসা ৫ম দিন: সম্মু/সাঙ্গু লেক ঘুরতে যাওয়া এবং গ্যাংটক ফিরে আসা। ৬ষ্ঠ দিন: সকাল বেলা গ্যাংটক থেকে শিলিগুড়ি এবং বাংলাবান্ধা হয়ে ঢাকা।
দরকারি কিছু তথ্য
উত্তর সিকিম যাত্রীদের অনুমতি গ্যাংটক থেকেই নিয়ে নিতে হয়। ভারতীয়দের ভোটার কার্ডের এক কপি জেরক্স ও ২ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিয়ে আবেদন করলে সহজেই মেলে এই অনুমতিপত্র। বাংলাদেশিদের লাগবে পাসপোর্ট, ভিসার ফটোকপি এবং ২ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি। গ্যাংটকের হোটেল বা যে কোনো ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে ডকুমেন্টগুলি জমা দিলে, তারাই আনিয়ে দেবে প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র। প্রত্যেকের ৮/১০ কপি করে পাসপোর্ট সাইজের ছবি সাথে পাসপোর্টের প্রথম পাতাসহ ভিসার ফটোকপি ৪/৫ সেট করে সাথে রাখতে হবে। সিকিম ঢোকার আগে থেকে শুরু করে হোটেলসহ প্রতিটি স্পটে যেতে অনুমতি নিতে হবে। অধিক উচ্চতার জায়গায় বেশি দৌড়ঝাঁপ না করাই ভালো।
সিকিম ভ্রমণ খরচ
ঢাকা থেকে হানিফের বাসে বাংলাবান্ধা যেতে জন প্রতি ভাড়া ৭০০ টাকা। আর ইমিগ্রেশন ও ট্যাক্সি ভাড়াসহ সিকিমে যেতে জনপ্রতি ১৮০০-২০০০ টাকা খরচ হবে। আবার নর্থ সিকিমের বিভিন্ন প্যাকেজের মাধ্যমে লাচুং ও ইয়ামথাং ভ্যালি ঘুরার জন্য খরচ পড়বে ১১,০০০-১৪,০০০ রুপি।
তবে, সিকিম রেস্ট্রিকট্রেড এরিয়া তাই ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে এখানে ঘুরাঘুরি করতে হবে আর নর্থ সিকিমের প্যাকেজ নিলে খরচ কম হবার সাথে সাথে ঘুরতেও সুবিধা হবে। হোটেল থেকে প্যাকেজ না নিয়ে কোনো ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে প্যাকেজ নিলে খরচ কম পড়বে। সিকিমে খাওয়া-দাওয়া, যাতায়াত ও ঘুরাঘুরি বাবদ ৬ দিন ৭ রাত থাকতে জনপ্রতি ১৬,০০০-২০,০০০ টাকার মতো লাগবে। তবে সিকিমে ৬/৭ জনের গ্রুপ করে যাতায়াত করলে ও হোটেল রুম শেয়ার করলে খরচ অনেক কম হবে।
কোথায় থাকবেন
সিকিমের গ্যাংটক, পেলিং, লাচুং ও এম জি মার্গে থাকার জন্য অনেক হোটেল আছে। হোটেল অনুযায়ী দুই বেডের ভাড়া লাগবে দেড় হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। তবে পর্যটন মৌসুমে হোটেল ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। একটু খোঁজখবর নিলে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে দুইজন রাত্রিযাপনের মতো কক্ষও মিলবে।
কোথায় কি খাবেন
সিকিমকে বলা হয় ‘Land of organic’ এখানে সব জিনিসই খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও ফ্রেশ, তাই সিকিমে বেড়াতে আসলে ভালো ও ফ্রেশ খাবার খেতে পারবেন এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন।
সতর্কতা: হোটেল, রিসোর্ট, যানবাহন ভাড়া ও অন্যান্য খরচ সময়ের সাথে পরিবর্তন হয় তাই প্রকাশিত তথ্য বর্তমানের সাথে মিল না থাকতে পারে। তাই অনুগ্রহ করে আপনি কোথায় ভ্রমণে যাওয়ার আগে বর্তমান ভাড়া ও খরচের তথ্য জেনে পরিকল্পনা করবেন।